ওলন্দাজ বিজ্ঞানী ভ্যানডার ওয়ালস্ (Van der Waals) সর্বপ্রথম বলেন যে, গ্যাসের গতিতত্ত্বে যে সকল স্বীকার্যের উপর ভিত্তি করে আদর্শ গ্যাস সমীকরণ PV = nRT বের করা হয়েছে, তাতে দুটি ভুল আছে। যে কারণে বাস্তব গ্যাস আদর্শ গ্যাসের সমীকরণ মেনে চলে না, অর্থাৎ আদর্শ আচরণ করে না। তাই বিজ্ঞানী ড্যানভার ওয়ালস্ বাস্তব গ্যাসের জন্য আদর্শ গ্যাসের স্বীকার্য সংশোধন করেন। তার দুটো সংশোধন হচ্ছে-
গ্যাসের আয়তন সংশোধন : গ্যাসের গতিতত্ত্বে একটি স্বীকার্য হচ্ছে, গ্যাসের অণুসমূহের নিজস্ব আয়তন গ্যাস পাত্রের আয়তনের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তা পুরোপুরি সঠিক নয়। যেকোন গ্যাসকে খুব কম তাপমাত্রা ও খুব বেশি চাপে তরল এবং কঠিন পদার্থে পরিণত করা যায়। তরল এবং কঠিন উভয় অবস্থায় অণুসমূহ পরস্পরের খুব কাছাকাছি থাকে, তার সত্ত্বেও তরল ও কঠিন বস্তুর একটি আয়তন আছে, যা একেবারে কম নয়। তরল ও কঠিন পদার্থকে যথেষ্ট চাপ দিয়ে আর বেশি সংকোচন করা যায় না। এসব থেকে বোঝা যায় যে, গ্যাসের অণুসমূহের একটি আয়তন আছে, যা একেবারে কম না।
আদর্শ গ্যাস সমীকরণে গ্যাস অণুসমূহের মুক্ত চলাচলের জন্য আয়তন v ধরা হয়েছে। বাস্তবিকপক্ষে তা সঠিক নয়৷ এক মোল বাস্তব গ্যাসের অণুসমূহের কার্যকর নিজস্ব আয়তন b হলে n মোল গ্যাসের জন্য V থেকে nb বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ গ্যাস অণুসমূহের জন্য মুক্ত স্থান = (V - nb) হবে।
গ্যাসের চাপ সংশোধন : গ্যাসের গতিতত্ত্বের আরেকটি স্বীকার্য হচ্ছে, অণুসমূহের মধ্যে কোন আকর্ষণ বা বিকর্ষণ নেই। এ ধারণাও সঠিক নয়। গ্যাসের অণুসমূহের মধ্যে কোন আকর্ষণ না থাকলে গ্যাসকে তরল বা কঠিন পদার্থে পরিণত করা যেত না এবং কঠিন ও তরল কোন পদার্থের অস্তিত্ব থাকত না। এছাড়া জুল-থমসনের পরীক্ষা থেকে অণুসমূহের আন্তঃআণবিক আকর্ষণের অস্তিত্বের সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায়। এ আকর্ষণ না থাকলে আদর্শ অবস্থায় গ্যাসের অণুসমূহ পাত্রের গায়ে যে পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করতো, বাস্তব গ্যাসের ক্ষেত্রে এ আন্তঃআণবিক আকর্ষণের কারণে তা অপেক্ষা কিছু কম পরিমাণ চাপ প্রয়োগ করে। অর্থাৎ বাস্তব গ্যাস যে চাপ প্রয়োগ করে, তা একই অবস্থায় গ্যাসটি আদর্শ হলে যে চাপ প্রয়োগ করতো, তার চেয়ে কম। তাই বাস্তব গ্যাসের বেলায় চাপ P এর পরিবর্তে P + আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বল হবে। ভ্যানডার ওয়ালস দেখান যে, n মোল গ্যাসের জন্য আন্তঃআণবিক আকর্ষণ বলের মান n2a / V2 এর সমান, এখানে a একটি ধ্রুবক। সুতরাং বাস্তব গ্যাসের চাপ হবে = P + (n²a / V²)
বাস্তব গ্যাসের বেলায় গ্যাসের নিজস্ব আয়তন ও আন্তঃআণবিক আকর্ষণজনিত চাপ সম্পৰ্কীয় উভয় বিচ্যুতির হিসাব করে বিজ্ঞানী ভ্যানডার ওয়ালস PV = WRT সমীকরণে সংশোধন এনে যে সমীকরণ তৈরি করেন, তা ভ্যানডার ওয়ালস্ সমীকরণ নামে পরিচিত। সুতরাং বাস্তব গ্যাসের অবস্থার সমীকরণটি হবে এমন-
(P + n²a/V²) (V - nb) = nRT
1 mol গ্যাসের জন্য এ সমীকরণে n = 1 ধরলে ভ্যানডার ওয়ালস্ সমীকরণটি দেখতে এমন হবে-
(P + a/V2) (V – b) = RT
উদাহরণ- 32g অক্সিজেন গ্যাসের জন্য ভ্যানডার ওয়ালস সমীকরণটি লিখ।
সমাধান- অক্সিজেন গ্যাসের গ্রাম আণবিক ভর হল 32g। সুতরাং 32g অক্সিজেন = 1 mol অক্সিজেন। ভ্যানডার ওয়ালস্ সমীকরণ অনুসারে- (P + n2a/V2) (V – nb) = nRT, এখানে n = গ্যাসের মোল সংখ্যা।
1 mol অক্সিজেন গ্যাসের জন্য এ সমীকরণে n = 1 বসিয়ে পাই,
(P + a/V2) (V – b) = RT
এটিই 1 মোল অক্সিজেন বা 32g অক্সিজেনের জন্য ভ্যানডার ওয়ালস্ সমীকরণ।
বাস্তব গ্যাসসমূহের আদর্শ গ্যাসের মত আচরণের শর্ত
গ্যাসের তাপমাত্রা যত বেশি হয় এবং চাপ যত কম হয়, গ্যাসের আয়তন তত বেশি হয়। গ্যাসের আয়তন যত বেশি হয়, তার তুলনায় গ্যাস অণুসমূহের আয়তন তত কম হয়। সুতরাং গ্যাসের গতিতত্ত্বের প্রথম ভুল দূর হয়। আবার গ্যাসের আয়তন যত বেশি হয়, অণুসমূহের মধ্যকার গড় দূরত্ব তত বেশি হয়, ফলে তাদের মধ্যে গড় আকর্ষণ তত কম হয়। সুতরাং গ্যাসের গতিতত্ত্বের দ্বিতীয় ভুলও দূর হয়। এ কারণে যতই বেশি তাপমাত্রা এবং কম চাপ ব্যবহৃত হয়, ততই বাস্তব গ্যাসের আচরণ আদর্শ গ্যাসের মত হয়।
যে উচ্চ তাপমাত্রার কোন বাস্তব গ্যাস আদর্শ গ্যাসের মত আচরণ করে এবং গ্যাসসূত্র মেনে চলে, ঐ তাপমাত্রাকে 'বয়েলের তাপমাত্রা' বলা হয়।